জীবন জয়ের ৬ পরিমাপ

 

ছয়টি পরিমাপ। ছয়টি সংখ্যা। জীবনে ভালোভাবে বেচেঁ থাকার জন্য এই ছয়টি বিজ্ঞানভিত্তিক পরিমাপ বা সংখ্যা আমার-আপনার জেনে নেয়া দরকার। সম্প্রতি একটি গবেষণার ফলাফলে পাওয়া গেছে এ তথ্য।
হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার কোন পর্যায়ে আপনার অবস্থান
, তা জানার জন্য এসব পরিমাপ সম্পর্কে আপনাকে অবহিত থাকা চাই। তিনটি পরিমাপ নিজে নিজেই মেপে দেখতে পারবেন­ আর এ জন্য প্রয়োজন একটি পেন্সিল, মাপবার ফিতা ও একটি ঘড়ি। ঘড়িটিতে সেকেন্ড মাপার কাঁটাটি থাকতে হবে। বাকি তিনটি পরিমাপ জানার জন্য যেতে হবে ডাক্তারের কাছে। এই পরিমাপ সংখ্যাগুলো লিখে রাখুন। আপনার

বেলায় এ পরিমাপ ওঠানামা নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রেখে নিয়ন্ত্রণে সচেতন থাকুন। তাহলে আপনার স্বাস্থ্য ও হৃদ-পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার অনেক কিছুই জানা থাকবে।


প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ক্যালরিঃ আসলে আপনি কতটুকু খাবার খান? প্রকৃতপক্ষে আপনি খাবেন ততটুকু, যা আপনার শরীরের জ্বালানি জোগান দিতে পারে। আমাদের খাবার শরীরে যে তাপ উৎপাদন করে তার পরিমাপই হচ্ছে ক্যালরি। এক এক ধরনের খাবারের তাপ উৎপাদন ক্ষমতা বা ক্যালরি মাত্রা এক এক রকম। কোন খাবারের ক্যালরি মাত্রা কত, তা বিজ্ঞানীরা আমাদের জানিয়েছেন। অতএব কী খাবার, কী পরিমাণে খেলাম, তা জেনে নিয়ে আমাদের প্রতিদিনের ক্যালরি গ্রহণ মাত্রাও আমরা জেনে নিতে পারি।
প্রতিটি মানুষ জানতে পারে তার প্রতিদিন কত ক্যালরির খাবার দরকার। আপনি নিজেও তা হিসাব করে বের করে নিতে পারেন। আপনার ওজন কিলোগ্রামে মেপে নিন। এই ওজনের সংখ্যাকে ২৮ থেকে ৩০ দিয়ে গুণ করুন
, আপনার সক্রিয়তার ওপর নির্ভর করে। সাধারণত বেশির ভাগ মহিলার সুস্থ দেহমনের জন্য দিনে সর্বোচ্চ ২০০০ ক্যালরি দরকার। পুরুষের প্রয়োজন প্রতিদিন ২৫৫০ ক্যালরির মতো। মোটামুটি হিসাবে সকারের নাস্তায় থাকা চাই ৩০০ থেকে ৪০০ ক্যালরি, দুপুরের খাবারে ৫০০ থেকে ৬০০ ক্যালরি এবং রাতের খাবারে ৬০০ থেকে ৭০০ ক্যালরি। এর সাথে দুই-তিনটি স্নেকে থাকে ১০০ থেকে ২০০ ক্যালরি প্রতিটিতে।
একটা কথা মনে রাখা দরকার
, শুধু ক্যালরির পরিমাণ গুণে গুণে হিসাব করে খাবার খাওয়াটাই আপনার দেহশক্তি জোগানোর জন্য যথেষ্ট নয়। বরং উত্তম কাজ হচ্ছে খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন আনা। এটি প্রায় অসম্ভব বেশি পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ, যদি আপনার নজর শুধু থাকে ফলের ও শাকসবজির ওপর। সুষ্ঠু পথ্যের অর্থ হচ্ছে এতে থাকা চাই প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন, মিনারেল, ও অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার। আর এগুলো সুস্থ হৃদযন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি হচ্ছে বয়স্ক লোকদের সতর্ক থাকতে হবে সুস্বাস্থ্যসমমত জীবনযাপনের জন্য শক্তিবল ও ওজন ঠিক রাখতে কী পরিমাণ খাবার খেতে হবে।


কোমরের আকারঃ আপনার শরীরের ওজন হৃদযন্ত্রের ওপর কতটুকু বিরূপ প্রভাব ফেলছে, তা পরিমাপের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম হলো কোমরের আকার মেপে দেখা। এখানে প্রয়োজন সঠিকভাবে কোমার ও নিতম্বর অনুপাত জেনে নেয়া। প্রথমে মেপে নিন কোমরের সবচেয়ে চিকন অংশের বেড়। এরপর মাপুন নিতম্বর সবচেয়ে মোটা অংশের বেড়। এ থেকে কোমরের বেড়কে নিতম্বের বেড় দিয়ে ভাগ করে কোমর ও নিতম্বের অনুপাত বের করুন। এই অনুপাত পুরুষের জন্য ০.৯০-এর চেয়ে বেশি ও মহিলাদের বেলায় ০.৮৫-এর চেয়ে বেশি হলে তা অস্বাভাবিক মোটা হওয়ার লক্ষণ। এটি বিপাকের লক্ষণ বা মেটাবলিক সিনড্রোম। তাদের হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।


যখন শরীরের চর্বি পেটের আশপাশে জমা হয় শরীরের অভ্যন্তর ভাগে
, চর্বিযুক্ত দেহকোষ থেকে উত্তেজক রাসায়নিক বেরিয়ে আসে। এর অর্থ আপনার হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তা ছাড়া আপনার ইনসুলিন প্রতিরোধের ঝুঁকি ও মেটাবলিক সিনড্রোমও বেড়ে যায়। কারণ উত্তেজক পদার্থ মাংসপেশি ও যকৃৎ কোষের স্বাভাবিক ক্রিয়া তখন বাধাগ্রস্ত হয়। অপর দিকে এতে আপনার ক্ষুধার সহ্য ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এর ফলে আপনার খাবার গ্রহণের মাত্রা বেড়ে যাবে। এতে করে ভূঁড়ি বেড়ে যেতে পারে।


কোমর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পেটের কোছাকাছি অর্থাৎ নাভি বরাবর আলতো করে বেল্ট বেঁধে  রাখুন। মনে রাখবেন বেল্ট যেন ঢিলেঢালা ও আরামপ্রদ হয়। পাকস্থলীর ওপর যেন তা অত্যধিক চাপ দিয়ে ভেতরের দিকে ঠেলে না দেয়। এশিয়ায় কোনো নারীর কোমরের বেড় ৮০ সেন্টিমিটারের বেশি হলেই স্বাস্থ্য ঝুঁকি শুরু হয়ে যায়। পুরুষের জন্য ঝুঁকির সৃষ্টি হয় কোমরের বেড় ৯০ সেন্টিমিটারের ওপর চলে গেলে। প্রতি দুই সপ্তাহ পরপর কোমর মেপে দেখুন।

 

কোলস্টেরোলঃ আপনার দেহে কোলস্টেরোলের মাত্রা মেপে নিন। শুধু তাই নয়, সে সাথে জানতে হবে ক্ষতিকর এলডিএল কোলস্টেরোল ও উপকারী এইচডিএল কোলস্টেরোলের মাত্রাও। রক্ত পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য যখন ডাক্তারের কাছে যান ল্যাবরেটরি রিপোর্টে এ দুই ধরনের কোলস্টোরোলের মাত্রা উল্লেখ থাকতে পারে। সম্ভবত উল্লেখ থাকতে পারে আপনার দেহের মোট কোলস্টেরোলের ও এইচডিএলর অনুপাত [টিসিঃ এইচডিএল]। যদি তাই হয়, তবে দুই ধরনের কলস্টেরোলের অনুপাত জানাতে বলুন। এই অনুপাত ডায়েরিতে লিখে রাখুন।
লক্ষ্য স্থির করুন
, মোট কোলস্টেরোল প্রতি লিটার রক্তের জন্য পাঁচ মিলিমোলের নিচে রাখতে এবং এলডিএল কোলস্টেরোল লেভেল প্রতি লিটার রক্তের জন্য ৩.৫ মিলিমোলের নিচে রাখতে। স্বাস্থ্যসমমত এইচডিএল লেভেল ১ মিলিমোল বা ততোধিক। বেশির ভাগ রক্ত পরীক্ষার আগে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা উপোস থাকতে হয়। যদি আপনার মোট কোলস্টেরোল অব্যাহতভাবে প্রতি লিটার রক্তে ৬ থেকে সাড়ে ৬ মিলিমোল থাকে, আপনার ডাক্তার আপনাকে জীবনযাত্রার ধরন পাল্টানোর পরামর্শ দেবেন কিংবা চিকিৎসা করতে বলবেন।


রক্তচাপঃ ধমনীর গায়ে রক্ত এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে। তাকেই বলে রক্তচাপ বা ব্লাডপ্রেসার। দিনে সাধারণত রক্তচাপ ওঠানামা করে। যখন রক্তচাপ বাড়তি থাকে, তখন আপনি ভোগেন হাইপারটেনশনে বা উচ্চ রক্তচাপে। এর ফলে হৃদরোগ বা স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকিতে ভোগেন। রক্ত চাপের মাত্রা ১৪০/৯০ মিলিমিটার অব মার্কারি কিংবা ততোধিক হলে তাকে উচ্চরক্তচাপ বিবেচনা করা হয়। রক্তচাপের মাত্রা ১২০/৮০ থেকে ১৩৯/৮৯ এমএমএইচজি, তখনো আপনি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। তখন উচ্চ রক্তচাপ রোধে পদক্ষেপ নিতে হবে। যতবারই ডাক্তারের কাছে যান, রক্তচাপ পরীক্ষা করে নিন। ডাক্তারের কাছে জেনে নিন কত দিন পরপর রক্তচাপ পরীক্ষা করতে হবে। নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করলে সম্ভাব্য শারীরিক সমস্যা থেকে বাঁচা যেতে পারে।


ট্রাইগ্লিসারাইডসঃ আমরা যেসব চর্বি ও কার্বোহাইড্রেট সেবন করি তা থেকেই তৈরি হয় ট্রাইগ্লিসারাইডস। এটি পরিবর্তিত হয়ে এমন আকার ধারণ করে যা জমা হয় চর্বি কোষগুলোতে। যখন শরীরে খাবারের মাঝামাঝি সময়ে অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন হয়, তখন ক্যাট টিস্যু বা চর্বিঝিল্লি থেকেও ট্রাইগ্লিসারাইড বের হয়। রক্ত স্রোতে সামান্য পরিমাণে ট্রাইগ্লিসারাইডস থাকাটা স্বাভাবিক, কিন্তু এর পরিমাণ বেড়ে গেলে করোনারি আটারি ডিজিজ বা শিরা দিয়ে হৃদপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালন জনিত রোগ দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে এই শিরঃপীড়া মহিলাদের ক্ষেত্রে বেশি হয়। স্বাভাবিক ট্রাইগ্লিসারাইডসের মাত্রা হচ্ছে প্রতি লিটার রক্তে দেড় মিলিমোল। উপোস থেকে কোলস্টেরোল পরীক্ষার জন্য রক্তের যে নমুনা দেয়া হয়, তা থেকেই ট্রাইগ্লিসারাইডস পরীক্ষা হয়। ডাক্তারের কাছ থেকেই জেনে নিন কত দিন পরপর আপনি এই পরীক্ষা চালাবেন।


হৃদসপন্দনের হারঃ আপনার পালস রেট বা হৃদসপন্দনের হার হচ্ছে সেই সংখ্যা, মিনিটে যতবার আপনার হৃদযন্ত্র কম্পিত হয়। প্রতিদিন সকালে আপনি পালস রেট জেনে নিন। সাধারণত স্বাভাবিক এই হৃদসপন্দন মিনিটে ৬০ থেকে ৯০ বার।
একটি ঘড়ি নিন। ঘড়িটির যেন সেকেন্ডের কাঁটা থাকে। আমরা যে জায়গায় ঘড়ি পরি
, হাতের সে জায়গাটা কিংবা ঘাড়ে হৃদসপন্দন সবচেয়ে ভালোভাবে মাপা যায়। ঘাড়ের চামড়ার ঠিক নিচ দিয়েই চলে গেছে ধমনী। আপনার তর্জনী ও মাঝের আঙুল দিয়ে হাতের কবজির ওপর চেপে ধরুন। দেখবেন হৃদসপন্দন আঙুলে অনুভূত হচ্ছে। ঘাড়ের পালস পাবেন কণ্ঠনালীর উভয় পাশে। আঙুল দিয়ে শ্বাসনালীর উভয় পাশে মৃদু চাপ দেন। যদি হৃদসপদন অনুভূত হয়। ১৫ সেকেন্ডে কতবার সপন্দন হলো গুনে নিন এবং তাকে ৪ দিয়ে গুণ করে নিন এটিই হবে প্রতি মিনিটে হৃদসপন্দনের হার।
মাসে একবার বিছানা ছাড়ার আগে হৃদসপন্দন মেপে নিন। ব্যায়াম করার অভ্যাস থাকলে সর্বোচ্চ সপন্দন হার মাপুন ব্যায়াম শেষ করার পরপর। অবসর সময়ের সপন্দন হারে নেমে আসতে কত সময় লাগে তা লক্ষ করুন। শরীর সুস্থতর অবস্থার দিকে গেলে ধীরে ধীরে এ সময় কমে আসবে।


আশা করি
, জীবন জয়ের জন্য এই ছয়টি পাঠমাপের ব্যাপারে এখন থেকে আরো সচেতন হবেন।

সৌজন্যেঃ নয়া দিগন্ত

 
 
 

 

copyright © 2005 - 2011. All rights reserved. e-Palki.com